আয়ু:
আয়ু হলো কিছু সময়ের সমষ্টি যেটাকে আমরা জন্ম ও মৃত্যুর মাঝখানের সময়টাকে বলতে পারি। পৃথিবীতে যখন একটি শিশু জন্ম নেয় তখন থেকে তার আয়ু গণনা শুরু হয়।
সুস্থ্য স্বাভাবিকভাবে সেই শিশুটি যদি বড় হয়, তবে গড় আয়ু হিসেবে হয়তো পৃথিবীতে সে ৬০ বা ৭০ বছর কিংবা তারও অধিক বাঁচতে পারে। কিন্তু আমরা দেখতে পাই, অনেকেই অকালে চলে যায়।
এই অকালে চলে যাওয়ার পেছনে অনেক কারণ থাকে যদিও সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে আয়ু পূর্ব নির্ধারিত। তবে আমরা যদি কিছু বিষয় মেনে চলি তাহলে অকালে মৃত্যু কিছুটা হলেও রোধ করা সম্ভব।
এই জন্য আমাদের কিছু অভ্যাসের চেষ্টা করতে হবে। সেই অভ্যাসগুলো হবে সবচেয়ে ভালো অভ্যাস। যেগুলো আমাদের আয়ুর কোনো ক্ষতি করবে না।
কোনো একজন ব্যক্তি যদি প্রচুর পরিমাণে সিগারেট বা নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবন করে তবে তার ফুসফুস, লিভার বা হৃদপিন্ডে যেকোন বড় ধরণের রোগ হতেই পারে।
আর বড় ধরণের রোগ হলে স্বাভাবিকভাবেই অকালে তার মৃত্যু হবে। এই মৃত্যুর জন্য কিন্তু সৃষ্টিকর্তা দায়ী নয়। যদিও সৃষ্টিকর্তা জানে যে, ওই ব্যক্তি এই এই কাজ করে এভাবে অকালে মারা যাবে।
যাই হোক, আমরা আলোচনা অত দীর্ঘ করবো না। আজকে মূলত আমরা জানবো কি কি কারণে মানুষের আয়ু কমে যেতে পারে। আয়ু কমে যাওয়ার পেছনে অনেকগুলো কারণকে দায়ী করা যায়। সেই কারণগুলো নিম্নে উল্লেখ করা হলো:
মধ্যরাতে খাবার খাওয়া: আমরা অনেকেই মধ্যরাতেও খাবার খাই। বাসায় দেরি করে ফিরলে এমনটা হওয়া অস্বাভাবিক নয়। তবে মধ্যরাতে মিষ্টি জাতীয় খাবার ও বেশি পরিমাণে লবণ আছে এমন খাবার খাওয়া নিষেধ।
এই খাবারগুলো মধ্যরাতে খেলে শরীরে হৃদরোগ ও ডায়াবেটিস রোগের ঝুঁকি বাড়ে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, রাতের খাবার খাওয়ার পরে শরীরে ট্রাইগ্লিসারাইড এর পরিমাণ বেড়ে যায়।
আর এই ট্রাইগ্লিসারাইড হলো বিপজ্জনক চর্বি যা রক্তে থাকে। এগুলো ফ্যাটি টিস্যুতে জমা হয়। আর অতিরিক্ত ফ্যাটি অ্যাসিড শরীরের জন্য কোনোভাবেই ভালো নয়।
আর শরীরে একবার যদি চর্বির পরিমাণ বেড়ে যায় (রক্তের মধ্যে) তবে তা থেকে রেহাই পাওয়া মুশকিল ব্যাপার। তাই রাতের খাবার ও সকালের খাবারের মধ্যে সর্বোচ্চ ১০ ঘন্টা ব্যবধান রাখুন।
মোবাইল ও কম্পিউটারে অত্যাধিক সময় ব্যবহার: বর্তমানে এই আধুনিক যুগে সবার হাতেই মোবাইল বা কম্পিউটার দেখা যায়। সবাই কম বেশি এগুলো ব্যবহার করে।
কিন্তু রাত জেগে জেগে অতিরিক্ত ভিডিও দেখা, গেম খেলা বা কাজ করা কোনোটাই শরীরের জন্য ভালো নয়। রাত জেগে এসব কিছু করলে আপনার শরীরে নানাবিধ রোগ বাসা বাধবে।
আমেরিকায় একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, যেসব তরুণ রাতের বেলা অত্যাধিক ভিডিও দেখেছিল তাদের নিম্ন স্লিপ কোয়ালিটিতে ভোগার সম্ভাবনা যারা রাত জেগে এসব করেনি তাদের তুলনায় ৯৮ শতাংশ বেশি।
রাতে ঘুম কম হলে দিনের বেলা নানাবিধ সমস্যা দেখা দেয়। গাড়ি চালালে দূর্ঘটনা হতে পারে। কাজে মনোযোগ নষ্ট হয়। বিভিন্ন অভিজ্ঞ ব্যক্তি বলেছেন, বিঘ্নিত ঘুমের পর কোনো কাজের পারফরমেন্স একজন মাতাল লোকের পারফমেন্স এর সমান।
সুস্থ্য থাকার জন্য প্রতিদিন অন্তত ৭ ঘন্টা বা তার বেশি সময় ঘুমানো প্রয়োজন। তাহলে শরীর ও মন সুস্থ্য থাকবে।
বেশি লবণ খাওয়া: আয়ু কমে যাওয়ার এটি একটি মারাত্মক এবং প্রধান কারণ। প্রতিদিন বেশি পরিমাণে সব খাবারেই লবণ খেলে স্বাস্থ্যের জন্য তা হুমকিস্বরুপ।
জার্নাল অব দা আমেরিকান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন এর প্রকাশিত একটি নিবন্ধ থেকে জানা যায় যে, খাবারে অতিরিক্ত লবণ খাওয়ার কারণে ৯.৫ শতাংশ মানুষের মৃত্যু হয়। এটাকে ডায়েট সম্পর্কিত মৃত্যুও বলা যায়।
অন্যদিকে, অতিরিক্ত লবণ খেলে হৃদপিন্ড এবং কিডনী মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। জানলে অবাক হবেন যে, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস ও স্ট্রোক এর মতো রোগগুলোর ক্ষেত্রে ৪৫.৪ শতাংশ মৃত্যুর জন্য দায়ী খাবারে অতিরিক্ত লবণের ব্যবহার।
হাত পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন না রাখা: আমরা বেশিরভাগ কাজে হাতের ব্যবহার করি। তাই বেশিরভাগ জীবাণুই হাতের সংস্পর্শে আসে। যদি ঠিকভাবে হাত না ধুয়ে কোনো খাবার খাই তাহলে তা পেটের মধ্যে চলে যাওয়াটাই স্বাভাবিক।
আর তারপর যেকোন রোগ হওয়াটাই স্বাভাবিক। তবে ডায়রিয়া সবচেয়ে বেশি হয়। আমেরিকার সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন এর দেয়া তথ্য মতে, ভালোভাবে হাত না ধোয়ার কারণে ২০০৩ সালে সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিন্ড্রোমের (এস,এ,আর,এস) প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল। তাতে অনেক মানুষ মারা গিয়েছিল।
আর তাই খাওয়ার আগে শুধু নয় – ঘরের বাইরে থেকে যাওয়ার পরেই সাবান পানি দিয়ে হাত ধুয়ে নিন। এতে আপনার আয়ু তাহলে কোনোভাবেই প্রভাবিত হবে না।
ফ্লসিং পরিহার করা: আমেরিকার নিউ ইয়র্ক সিটির ডেন্টিস্ট সাউল প্রেসনার বলেন, ফ্লসিং মুখের ভেতরের মাইক্রো অর্গানিজমগুলোকে কমিয়ে দেয়।
এতে মুখের ভেতরে কোনো প্রকার ইনফ্লামেইশান (প্রদাহ) হয় না বা কমে যায়। যুক্তিসংগত যে, মাড়িতে ইনফ্লামেইশান কমে গেলে মাড়ি থেকে রক্ত ক্ষরণের সম্ভাবনা কমে যাবে। ফলশ্রুতিতে, মুখ থেকে ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস রক্তের মধ্যে প্রবেশ করবে না।
ডেন্টিস্ট সাউল প্রেসনার আরও বলেছেন যে, মাড়ির রোগ মানুষের মৃত্যু ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু নিয়মিত ফ্লসিং করলে আয়ু ছয় বছর পর্যন্ত বাড়তে পারে। তাই আয়ু ঠিক রাখতে বা বাড়াতে নিয়মিত ফ্লসিং করতে পারেন।
অনিরাপদ যৌন মিলন: প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে অনিরাপদ যৌন মিলন আপনার আয়ুতে প্রভাব ফেলতে পারে। অনিরাপদ যৌন মিলন আমাদের নানাভাবে ক্ষতি করতে পারে।
যাদের এইডস রোগ হয় তাদেরকে ‘ডেথ সেনটেন্স’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তার মানে তাদের মৃত্যু নিশ্চিত অল্প কিছুদিনের মধ্যে। আর এইডস রোগ হওয়ার মূল কারণ হলো অনিরাপদ যৌন মিলন।
বর্তমানে যদিও এইডস রোগের জন্য কিছু চিকিৎসা পদ্ধতি রয়েছে কিন্তু তা সত্বেও তা আপনার জীবনকালের দৈর্ঘ্য অর্থাৎ আয়ু কমিয়ে দিতে সক্ষম – বলেছেন ড. মুর।
ড. মুর আরো বলেছেন যে, অন্যান্য যৌন সংক্রমিত রোগও জীবনের জন্য হুমকিস্বরুপ হতে পারে। তাই যৌন মিলনের সময় নিরাপত্তার স্বার্থে কনডম ব্যবহার করুন।
হাতের নখ দাঁত দিয়ে কামড়ানো: অনেকের কাছেই এটি একটি অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়। আসলে এটি একটি বাজে অভ্যাস। দাঁত দিয়ে নখ কামড়ানোর ফলে ওরাল ব্যাকটেরিয়া (এইক্যানেলা করোডেন্স) অথবা স্কিন ব্যাকটেরিয়া (স্ট্রেপটোকক্বাস/স্ট্যাফাইলোকক্বাস) আপনার ত্বকের সংস্পর্শে আসতে পারে।
পেটের ভেতরে জীবাণুগুলো মুহূর্তেই প্রবেশ করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন স্কুল অব মেডিসিন এন্ড হসপিটালের ডার্মাটোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক অ্যাডাম ফ্রাইডম্যান বলেছেন, নখ কামড়ানোর ফলে প্যারোনাইশিয়া নামক সংক্রমণ হতে পারে যা অতি বেদনাদায়ক।
সুতরাং এটা স্পষ্ট যে, দাঁত দিয়ে নখ কামড়ানোর ফলে পরোক্ষভাবে তা আপনার আয়ুতে প্রভাব ফেলতে পারে।
ব্রণ ফাঁটানো: মুখে ব্রণ অনেকেরই হয়। বয়ঃসন্ধিকালে ব্রণ প্রায় সবারই কম বেশি হয়। এটি একটি সাধারণ সমস্যা। ব্রণ হলে অনেকেই তা ফাটিয়ে ফেলেন। তখন তা খোলাসা হয়ে যায়।
আর এই খোলাসা জায়গা দিয়ে বিভিন্ন ক্ষতিকর জীবাণু (যেমন মিথিলিন রেজিস্ট্যান্স স্ট্যাফ অরিয়াস) রক্তে প্রবেশ করতে পারে। আর এতে ফোঁড়া, হেয়ার ফলিকলের ফোঁড়া, কারবাঙ্কল্স এর মতো স্কিন ইনফেকশন হতে পারে।
আপনি জানলে অবাক হবেন যে, ব্রণ ফাঁটানো হলে মিথিলিন রেজিস্ট্যান্স স্ট্যাফ অরিয়াস নামক জীবাণু সহজেই রক্তনালী, চোখ এবং কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রে প্রবেশ করে ক্ষতি করতে পারে।
সকালের নাস্তা না করা: সকালের নাস্তা খাওয়া প্রত্যেকের জন্য জরুরি। গ্রামাঞ্চলে এ বিষয়টির কোনো গুরুত্ব নেই। দেখা যায়, সকালে উঠে সবাই কাজে চলে যায়। সেই ১০ টা কিংবা ১১ টায় এসে সরাসরি ভাত খেয়ে নেয়।
কিন্তু সকালের খাবার আমাদের সারাদিনের ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণ করে। তাই সকালে যদি কেউ নাস্তা না করে তাহলে দিনের অন্যান্য সময়ে তার ক্ষুধা অনেকাংশে বেড়ে যাবে।
আর সকালের নাস্তা বাদ দিয়ে দিনের অন্যান্য সময়ে বেশি পরিমাণ খেলে শরীরের ওজন বেড়ে যায়। আর এটাতো অবশ্যই জানেন যে, অতিরিক্ত ওজন হার্ট এর রোগ সৃষ্টি করে এবং এতে মৃত্যু ঝুকি বেড়ে যায়। সুতরাং পরোক্ষভাবে আপনার আয়ু কমিয়ে দিচ্ছে।
বংশগত কারণ: হয়তো অবাক হচ্ছেন। কিন্তু এটাই ঠিক যে, বংশগত কারণেও আয়ু প্রভাবিত হতে পারে। সাধারণত দেখা যায় যে, আপনার পূর্ব পুরুষগণ যতোটা আয়ু লাভ করেছিলেন আপনিও সেই পরিমাণ আয়ু লাভ করবেন। কিছুটা কম বেশি হতে পারে। তবে কিছু ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রমও লক্ষণীয়।
অলস হলে: অলস ব্যক্তি সাধারণত কোথাও সম্মান পায় না। জীবনে কোনো উন্নতিও করতে পারে না। কর্মক্ষেত্রে কিংবা বাড়িতে সারাক্ষণ বসে থাকলে আয়ু কমে যায়।
বাসায় টিভি বা কম্পিউটারে যারা কোনো প্রকার গুরুত্বপূর্ণ কাজ বাদে সময় কাটায় তাদের শরীরেও বাসা বাঁধে নানা প্রকার রোগ। এতেও পরোক্ষভাবে শারিরীক কার্যক্রম ব্যাহত হয় এবং আয়ু কমে যায়।
বিয়ে বিচ্ছেদ: বিভিন্ন গবেষণা থেকে জানা যায়, বিবাহিত মানুষের আয়ু বেশি হয়। আর বিয়ের পর বিচ্ছেদ হলে উল্টোটা ঘটে অর্থাৎ নানা কারণে আয়ু কমতে থাকে।
আরও পড়ুন: সোরিয়াসিস নামক চর্ম রোগ থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় – বাস্তব
শিক্ষার অভাব: যুগের সাথে তাল মিলিয়ে সঠিকভাবে জীবন-যাপন করতে হলে আপনাকে অবশ্যই শিক্ষা অর্জন করতে হবে। সাধারণত যারা শিক্ষিত তারা সঠিকভাবে জীবন-যাপন করার চেষ্টা করে আর যারা শিক্ষিত নয় তাদের কিছু অংশ নানা কারণে অকালে মারা যায়।
পরিশেষে বলা যায়, জন্ম-মৃত্যু যদিও আল্লাহর হাতে তবুও আপনি চাইলে সুন্দরভাবে আপনার জীবনটা কাটাতে পারবেন। মানুষের জীবনে যাই ঘটুক না কেন তার পেছনে কোনো না কোনো কারণ থাকে।
খারাপ কারণগুলো তৈরী হওয়ার জন্য আপনিই কোনো না কোনোভাবে কিন্তু দায়ী। সেই কারণগুলো যেন তৈরী না হয় সেদিকে নজর দিন।
অকালমৃত্যু আমাদের কারোরী কাম্য নয়। অকাল মৃত্যু রোধে কিছু কাজ আপনি ঠিকই করতে পারেন। উপরে উল্লিখিত কাজগুলো করা বন্ধ করুন।
দেখবেন, আয়ু আপনার না বাড়ুক কিন্তু আপনি যতোদিন বাঁচবেন, সুন্দরভাবে বাঁচতে পারবেন। আমরা সবাই সুন্দরভাবে জীবনের পুরো সময়টাকে পৃথিবীতে কাটিয়ে দিতে চাই। তাই আমাদের সাবধান হওয়া উচিত।