আর্সেনিক কি?
আর্সেনিক এর সাথে আমরা সবাই পরিচিত। এটাকে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর বিষ বলা হয়। সাধারণত পানিতে দ্রবীভূত অবস্থায় আর্সেনিক থাকে।
এর কোনো গন্ধ, রং বা স্বাদ নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেয়া তথ্য অনুযায়ী, প্রতি লিটার পানিতে যদি আর্সেনিকের উপস্থিতি ০.০৫ মিলিগ্রাম এর বেশি হয় তবে তা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
আমরা সাধারণত নলকূপের সাহায্যে পানি উত্তোলন করি (গ্রামাঞ্চল)। দেখা গেছে যে, ভূ-গর্ভের ২য় স্তরের পানিতে কেবল আর্সেনিক পাওয়া যায়।
বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে এটি অন্যতম পর্যায়ে রয়েছে। কারণ, বাংলাদেশের প্রায় জায়গায়-ই পানিতে এই ক্ষতিকর উপাদানটি বেশি পরিমাণে পাওয়া যায়।
আজ আমরা আর্সেনিক দূষণ এর ফলে ক্ষতি ও এ থেকে পরিত্রাণের উপায় সম্পর্কে জানবো। কথা না বাড়িয়ে মূল আলোচনায় যাওয়া যাক।
আর্সেনিক যুক্ত পানি পান করলে যেসব ক্ষতি হয়:
আর্সেনিক যুক্ত পানি পান করলে অনেক ক্ষতি হয়। আমরা বেশিরভাগ মানুষ এ সম্পর্কে উদাসীন। দেখা গেছে, টিউবওয়েলের পানিতে আর্সেনিক আছে জেনেও আমরা প্রতিনিয়ত সেই পানি পান করছি।
আসলে আর্সেনিক যুক্ত পানি খেলে সমস্যা তাৎক্ষনিক ধরা পড়ে না। আর তাই আমরা বিষয়টিতে মনোযোগ দেই না। কিন্তু দীর্ঘদিন পর শরীরে নানাবিধ বিরুপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। নিচে প্রাথমিক পর্যায়ের সমস্যাগুলো উল্লেখ করা হলো।
- শরীরের চামড়া মোটা ও খসখসে হয়ে যেতে পারে। কিছুদিন পর ছোট ছোট শক্ত গুটির মতো বের হয়। এরপরে সেগুলোতে কালো কালো দাগ হয়ে যায়।
- আর্সেনিকে আক্রান্ত রোগীর শরীরে কালো কালো দাগ দেখা যায়। গায়ের রং কালো হয়ে যায় এবং ফুস্কুড়ির মতো উঠে।
- পাতলা পায়খানা হতে পারে। সাথে বমি-বমি ভাব কিংবা বমি হতে পারে।
- মুখে ঘা হতে পারে। রক্ত আমাশয় শুরু হতে পারে।
- খাওয়ায় অরুচি চলে আসে। রোগী কিছু খেতে চায় না। সব খাবারে তিক্ততা আসে।
- অনেক রোগীর ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে, জিহ্বার উপর এবং শরীরের বিভিন্ন জায়গায় কালো হয়ে যায়।
প্রাথমিক লক্ষণগুলো দেখা দেয়ার পর আবার দ্বিতীয় পর্যায়ে আরও কিছু লক্ষণ দেখা দিতে পারে। সেগুলো নিচে উল্লেখ করা হলো।
- শরীরের চামড়ার বিভিন্ন জায়গায় বেশি পরিমাণে সাদা, কালো বা লাল দাগ দেখা যায়।
- যারা একটু বেশি বয়স্ক তাদের হাত-পায়ের তালু ফেঁটে যায় ও শক্ত গুটি ওঠে।
- হাত-পা ফুলে যায়। ব্যথা হয়। চামড়া খসখসে হয়ে যায়।
জটিল পর্যায়ে চলে গেলে যেসব সমস্যা হতে পারে তা নিচে উল্লেখ করা হলো। তবে আর্সেনিক সমস্যায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকলে প্রথমাবস্থায় চিকিৎসা নিন।
- বেশিরভাগ রোগীর শেষ পর্যায়ে এসে কিডনী, লিভার ও ফুসফুস বড় হয়ে যায়।
- টিউমার দেখা দেয়। টিউমার শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোতেই বেশি দেখা যায়।
- রক্ত বমি দেখা দেয়। রক্তবমি হলে রোগী খুব অস্বস্তি ভোগ করে।
- শারিরীক ব্যথার পাশাপাশি পেটে ও মাথায় ব্যথা হতে পারে।
- শরীরের চামড়া, মূত্রথলি ও ফুসফুসে ক্যান্সার হতে পারে।
- হাত-পায়ের যেকোন অংশে ঘা হয় এবং সেখানে দ্রুত পঁচন দেখা দেয়।
- লিভার ও কিডনী ঠিক মতো কাজ করতে পারে না। একটা সময় পুরোপুরি অকেজো হয়ে যায়।
- জন্ডিস রোগ দেখা দেয়। ফলশ্রুতিতে, সারা শরীর হলুদাভাব ধারণ করে।
আর্সেনিক থেকে বাঁচার উপায়:
কোনো কারণে আর্সেনিক রোগের উপসর্গ দেখা দিলে অবশ্যই নিকটস্থ ডাক্তারের সাথে পরামর্শ নিন এবং প্রাথমিক অবস্থায় চিকিৎসা নিন। তাহলে জটিল সমস্যাগুলোর মুখোমুখি হতে হবে না।
- বাড়ির টিউবওয়েল এ যদি কখনো আর্সেনিক ধরা পড়ে তাহলে সেই টিউবওয়েল এর পানি পান করা থেকে বিরত থাকুন। কখনোই হেলা করে ঐ টিউবওয়েল এর পানি পান করতে যাবেন না। প্রয়োজনে টিউবওয়েল অন্যত্র স্থাপন করুন।
- যদি বাড়িতে টিউবওয়েল না থাকে এবং আপনি যদি নদী, পুকুর বা বিলের পানি পান করে থাকেন তবে অবশ্যই পানি ফুটিয়ে নেবেন। অন্তত ২৫ মিনিট ধরে ফুটিয়ে নিন। তারপর ঠাণ্ডা হলে পান করুন।
- যখন বর্ষাকাল আসে তখন প্রচুর পরিমাণে বৃষ্টি হয়। ইচ্ছে করলে বৃষ্টির পানি পান করতে পারেন। তবে বৃষ্টি শুরু হওয়ার অন্তত ৫/৭ মিনিট পরে পরিষ্কার গামলা বা বালতিতে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করুন।
- আর্সেনিকে যারা আক্রান্ত হয়েছেন তাদের খাবারের কোনো বালাই নেই। সব ধরণের খাবার খেতে পারবেন। তবে সবুজ শাক-সবজি ও পুষ্টিকর খাবার বেশি পরিমাণে খাওয়া উচিত।
আর্সেনিক থেকে রক্ষা পেতে করণীয়:
- বাড়িতে টিউবওয়েল বসানোর পরে পানিতে আর্সেনিকের পরিমাণ কতটুকু পরিমাণ আছে তা পরীক্ষা করে নেন। যদি তা সহনীয় মাত্রায় থাকে তবে তো সমস্যা নেই। কিন্তু মাত্রা বেশি হলে কখনোই ঐ পানি পান করা উচিত হবে না।
- বুদ্ধিমানের মতো একটি কাজ করতে পারেন। বাড়িতে নতুন টিউবওয়েল বসানোর পূর্বে আশেপাশে যদি টিউবওয়েল থাকে সেগুলোর পানিতে কতটুকু পরিমাণে আর্সেনিক আছে তা যাচাই করে নিতে পারেন।
- টিউবওয়েল বসানোর পরে গোড়ার সব কাজ সম্পন্ন করার পূর্বেই আর্সেনিক পরীক্ষা করে নিন। প্রকৃত অর্থে আমরা কেউ-ই এ কাজটি করি না।
- সরকার কর্তৃক নির্ধারিত নিয়ম হলো, যদি টিউবওয়েল এর পানিতে আর্সেনিক থাকে তাহলে তার মুখে লাল রং করে দিতে হবে। আর না থাকলে সবুজ রং করে দিতে হবে। তাহলে সচেতনতা বাড়বে।
- যদি কোনো টিউবওয়েল এর পানিতে আর্সেনিক না থাকে (পরীক্ষা করে জানা গেছে) তারপরও অন্তত ৬ মাস পর একবার ঐ টিউবওয়েল এর পানিতে আর্সেনিক এর মাত্রা পরীক্ষা করে নিতে হবে। কারণ, পরবর্তীতে আর্সেনিক চলে আসতে পারে।
- রান্নার কাজে কিংবা খাওয়ার কাজে কখনোই আর্সেনিকযুক্ত পানি ব্যবহার করবেন না।
- এখনও গ্রামের কোথাও কোথাও পাত কুয়োর স্থাপনা দেখা যায়। তাই কুয়োর পানির আর্সেনিকও পরীক্ষা করে নেয়া উচিত।
- নদী, বিল কিংবা খাল-বিলের পানি পান করার ক্ষেত্রে অবশ্যই ফুটিয়ে নিতে হবে। তাই ১ কলসি পানিতে (প্রায় ২০ লিটার) আধা চামচ (১০ মিলিগ্রাম পরিমাণ) ফিটকিরি মিশিয়ে নিয়ে ২ বা ৩ ঘন্টা অন্তত রেখে দিতে হবে। কলসির পানির ময়লা যাতে নিচে জমা হয়ে থাকে তাই ফিটকিরি মেশানো হয়। তারপর পানি অন্য পাত্রে ঢেলে নিয়ে ভালো করে ফুটিয়ে পান করতে হবে।
আরও পড়ুন: মধু সম্পর্কে ১৫টি গোপন তথ্য জেনে নিন।
চেষ্টা করবেন আর্সেনিক যুক্ত পানি একেবারে না খাওয়ার জন্য। কেননা, পানি ফুটালেও তাতে আর্সেনিক এর উপস্থিতি থাকতে পারে। আপনি জানলে অবাক হবেন যে, পানি শুকিয়ে গেলে তাতে আর্সেনিক এর ঘনত্ব আরো অনেকাংশে বেড়ে যায়।
পরিশেষে বলতে চাই, পানিতে আর্সেনিক দূষণ বাংলাদেশের জন্য বড় একটি সমস্যা। এই সমস্যার অন্তরালে রয়েছে মানুষের অসচেতনতা।
সবাই যদি একটু একটু করে সচেতন হই তাহলে আর্সেনিক দূষণ রোধ করা সম্ভব। আরেকটি ব্যাপার হলো – আর্সেনিক যুক্ত পানি পান করলে সমস্যাগুলো তাৎক্ষনিক দেখা যায় না।
আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করলে এর লক্ষণ ৬ মাস থেকে শুরু করে ৬ বছর পরেও দেখা দিতে পারে। আপনি যদি নিয়মিত এই দূষিত পানি পান করেন তবে আপনার শরীরে রোগ বাঁসা বাধবে এটা নিশ্চিত। তবে একটু সময়ের ব্যাপার মাত্র। তাই আর্সেনিক দূষণ প্রতিরোধে এখন থেকেই সাবধান হোন।