বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট ও বাঙালি হিসেবে আমাদের করণীয় প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। আলোচনাটি করেছেন ডা. মোঃ তাজুল ইসলাম। আশা করি, জ্ঞানগর্ভ এই আলোচনা থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে আসবে। তো আর কথা নয় – সরাসরি যাচ্ছি মূল নিবন্ধে।
১. চলমান কোভিড-১৯ মহামারী এবং তৎপরবর্তী রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বৈশ্বিক অর্থনীতি এক কঠিন টালমাটাল অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সারা দুনিয়াজোড়া মুদ্রাস্ফীতি হু-হু করে বাড়ছে।
পার্শ্ববর্তী সার্কের দেশ শ্রীলংকা ইতিমধ্যেই নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করেছে। অর্থনৈতিক দিক থেকে তারা ভেঙে পড়েছে। প্রবল গণ-আন্দোলনের মুখে সেখানে সরকার পতন হয়েছে। প্রবল পরাক্রমশালী প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন।
অথচ মাত্র দুই বছর আগেও শিক্ষা, সংস্কৃতি, পর্যটন, সামাজিক পরিকাঠামোসহ অর্থনীতির সকল সূচকে শ্রীলংকাই ছিল সার্কের ৮ দেশের মধ্যে সবার উপরে। মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে তাদের এই পাতালসম অধঃপতন বিশাল ভাবনার বিষয়।
২. বিশ্ব অর্থনীতির এই উথাল-পাতাল অবস্থা সামাল দিতে গিয়ে পৃথিবীর প্রায় সকল দেশকেই কোন না কোন জরুরী ও অতীব প্রয়োজনীয় উদ্ধার প্রক্রিয়া বা (বেইল আউট) প্ল্যান গ্রহণ করতে হয়েছে।
যার জন্যে পৃথিবীর প্রায় সকল দেশ ও সরকারকেই অত্যন্ত কঠিন ও অজনপ্রিয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়েছে। বিশ্ব রাজনীতি ও অর্থনীতির এক নম্বর মোড়ল খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতির হার এখন গত চল্লিশ বছরের মধ্যে সবচাইতে বেশী প্রায় ৯.৫%। তারাও অর্থনৈতিক দিক থেকে খারাপ অবস্থায় আছে।
ফলে তারাও মুদ্রা সংকোচন নীতি গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে। যেখানে ব্যাংক ঋণের সুদের হার ছিল প্রায় শুন্য শতাংশ, সম্প্রতি তারা তা এক শতাংশ বাড়িয়েছে।
মুখে স্বীকার করুক আর নাই করুক, উচ্চ মাত্রার মূল্যস্ফীতি ও সুদের হার বাড়ানোর ফলে মার্কিন জনগণও ব্যয়সংকোচন নীতি গ্রহণ করে পূর্বের চাইতে আঁট-সাঁট ও কষ্টে দিন যাপন করছে, এটা অনিবার্য। কোন উচ্চবাচ্য না করেই আমেরিকান জনগণ তা মেনে নিয়েছে।
৩. সন্দেহ নেই, কোভিড-১৯ এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতিও বিরাট ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। আমদানি রফতানির ভারসাম্যে ফারাকের কারণে বাজেট ঘাটতি বেড়েছে।
যুদ্ধের ডামাডোলে তেলের দাম সর্বকালের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। বেড়েছে প্রায় সকল আমদানি পণ্যের দামও। এতো অনাকাঙ্ক্ষিত চাপ সামাল দিতে গিয়ে সরকারকে হিমসিম খেতে হচ্ছে।
এতো অধিক দামে জ্বালানি তেল কিনে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে তা আবার ভর্তুকি মূল্যে বিতরণ করা সরকারের পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছি। বাধ্য হয়ে সরকার তেল আমদানি কমিয়ে এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন হ্রাস করে লোডশেডিং এর পথে হেঁটেছে।
শুধু তাই নয় জ্বালানি তেলের দাম বাজারের উপর ছেড়ে দিয়ে বা বড় আকারের মূল্য বৃদ্ধি করে অতি অজনপ্রিয় সিদ্ধান্ত নিতেও বাধ্য হয়েছে। সামনে নির্বাচন, সরকার কি জানে না যে এর ফল কি হতে পারে! অবশ্যই জানে এবং জেনেশুনে বাধ্য হয়েই সরকারকে এই বন্ধুর পথে পা বাড়াতে হয়েছে।
বিলাস দ্রব্যের আমদানি নিরুৎসাহিত করার জন্যে বিলাসী পণ্যের ট্যাক্স বাড়িয়ে প্রায় দ্বিগুণ করা হয়েছে। মন্ত্রী আমলাদের অতি প্রয়োজন ছাড়া বিদেশ সফর ও প্রশিক্ষণ বাতিল করা হয়েছে।
টেলিটকের ‘ফাইভ জি’ আপাতত স্থগিত করে দেয়া হয়েছে। এসবই করা হয়েছে আগাম সতর্কতা হিসেবে। দেশটাকে দেউলিয়াপনা থেকে রক্ষা করার জন্যে! এদেশের অবস্থা যেন শ্রীলংকার মতো না হয় তা থেকে জনগণকে রক্ষা করার জন্যে।
এটিই একটি দেশপ্রেমিক সরকারের আগাম কার্যকরী পদক্ষেপ বলে মনে করি। দেশটিকে যদি আমার পরিবারের সঙ্গে তুলনা করা যায় তবে পরিবারের কর্তা হিসেবে আমিও তাই করতাম। এর বাস্তব ফলাফল কতটুকু ফলপ্রসূ বা ফলদায়ক হবে তা বুঝা যাবে অন্তত আরো কয়েক মাস পরে।
শুধু তা করেই সরকার ক্ষান্ত হয়নি! বৈদেশিক ঋণের জন্যে আই.এম.এফ ও বিশ্ব ব্যাংকের দ্বারস্থ হয়েছে। গতকাল বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের জন্যে ৩০ কোটি ডলার বা ২৮৫৪ কোটি টাকা ঋণ মঞ্জুরও করেছে।
বাংলাদেশ আই.এম.এফ এর কাছেও প্রায় ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ চেয়েছে। সেটা নিয়ে আলাপ আলোচনা চলছে। আশা করা যায় বাংলাদেশ আই.এম.এফ এই ঋণও পেয়ে যাবে।
বাংলাদেশের এই ঋণ চাওয়া নিয়ে এক শ্রেণীর ফেসবুকীয় উজবুক অর্থনীতিবিদ হেই হেই সব গেল গেল বলে জিকির তুলছে। ব্যাপারখানি যেন এমন যে, বাংলাদেশ এর আগে আর কোনদিন বিশ্বব্যাংকের বা আই.এম.এফ এর কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করেনি, বা ঋণ চায়নি।
এরা যেকোন মাপের হীনমন্য উজবুক তা বলতেও আমার দ্বিধা হচ্ছে। এই হীনমন্য উজবুকদের কখনোই আমরা আলোর পথে আনতে পারবো না, তা জানি। কারণ এদের কাছে একটাই বই আছে আর সেটা হোল জোকার মামার ফেসবই।
সেই বইয়ের আবার বিশেষ চ্যাপ্টার আছে, সেটা হোল ‘বাঁশের কেল্লা।’ এই বাঁশের কেল্লা ছাড়া পৃথিবীর আর কোন বই এরা পড়ে না। এই বাঁশের কেল্লায় চোখ বুলিয়েই এরা একেকজন বিশাল মাপের অর্থনীতিবিদ সেজে বসে আছে।
এই হীনমন্য উজবুকরা পৃথিবীর মানুষের কাছে নিজ দেশের বদনাম করে, নিজ দেশকে খাটো করে, আমাদের সমাজ ব্যবস্থার দুর্বল দিকগুলো তুলে ধরে পৈশাচিক আনন্দ লাভ করে।
এই শ্রেণীর হীনমন্য উজবুক আমাদের দেশেও প্রচুর আছে, বিদেশেও ওরা সংখ্যায় অনেক। আদতে এসব রাজাকারের ছাও পোনা উজবুকরা আমার টার্গেট পিপল নয়।
তার বিপরীতে যারা জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চা করেন, পৃথিবীটা কিভাবে চলছে জানতে আগ্রহী তাদের জন্যেই আমার এই সামান্য পরিশ্রম, যেটুকু বিচক্ষণতা আছে তা দিয়ে মানুষকে সচেতন করার সামান্য প্রয়াস।
পৃথিবীতে কার বৈদেশিক ঋণের পরিমান কতো। মাথাপিছু তা কতো করে দাঁড়ায় তার একটি বিশ্লেষণধর্মী লিখা কাল থেকে ধারাবাহিকভাবে লিখবো। কোন বাগাড়ম্বর নয়; অবশ্যই তা বাস্তবসম্মত এবং বিভিন্ন তথ্যসূত্র উল্লেখ করেই লিখবো।
প্রথমেই শুরু করবো সবচাইতে বড় মোড়ল ইউনাইটেড স্টেটসকে দিয়ে। জানি না সেখানে বসবাসরত আমার বন্ধুদের চুলকানি তাতে আরো বেড়ে যায় কি না।
তবে কথা দিচ্ছি শুধু উইনাইটেড স্টেটস নয়; বাদ যাবে না শ্রীলংকা ভুটান, পাকিস্তান, এল সালভাদর কিংবা উগান্ডাও। আমার পাঠকবৃন্দকে তথ্যবহুল এই লিখাগুলো পড়ার অনুরোধ রাখছি।
এখন শত কষ্ট হলেও এদেশের একজন সুনাগরিক হিসেবে এই চলমান সংকট থেকে উত্তরণের জন্যে এই মূহুর্তে সরকারের পাশে দাঁড়িয়ে সরকারকে সর্বাত্মক সহযোগীতা করা ছাড়া আমাদের সামনে আর কোন ভালো গত্যন্তর নেই।
৪. আজকের লিখাটি শেষ করবো একটি সুখবর দিয়ে। বাংলাদেশের যা কিছু ভালো, যা কিছু সুন্দর, যা কিছু সত্য ও সম্মানের তা আমি তুলে ধরবোই।
কারণ এদেশটায় আমি জন্মেছি, এদেশের খেয়ে পড়ে, এদেশের ধুলোবালি মাখা আলো বাতাস গায়ে মেখে মানুষ হয়েছি। কাজেই একজন সুনাগরিক হিসেবে এদেশটাকে ভালোবেসে একে আপহোল্ড করার দায়িত্ব স্বেচ্ছায় নিজ স্কন্ধে তুলে নিয়েছি।
একজন সুনাগরিক হিসেবে এটাকে আমার পবিত্র দায়িত্ব বলেই মনে করি। হীনমন্য উজবুকদের বিপরীতে আমার পজিটিভ বাংলাদেশকে আমি তুলে ধরবোই। তাতে কারো গা জ্বললে জ্বলুক, চুলকানি বাড়লেও বারুক।
চলতি বছরে শ্রীলঙ্কা ঋণখেলাপি হওয়ার পরে, অনেকের মনেই প্রশ্ন জেগেছে বাংলাদেশ কতটা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। অতি সম্প্রতি কানাডাভিত্তিক সংবাদ প্রতিষ্ঠান ভিজ্যুয়াল ক্যাপিটালিস্ট ব্লুমবার্গের ডেটা ব্যবহার করে বৈদেশিক ঋণখেলাপি হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে এমন ২৫টি দেশের তালিকা প্রকাশ করেছে।
সুখবর হচ্ছে, প্রকাশিত ২৫টি ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম নেই। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে নাম রয়েছে একমাত্র উজবুকদের পিয়ারের দেশ পাকিস্তানের। আর আছে আরেক পিয়ারের দেশ তুরস্কের। কষ্ট করে সময় দিয়ে এই নিবন্ধ পড়ার জন্যে অগ্রীম ধন্যবাদ দিয়ে রাখছি সকল পাঠক পাঠিকাদেরকে।
লিখেছেন: ডা. মোঃ তাজুল ইসলাম (এমপিএইচ)
(লেখক সম্পর্কে তথ্য আরও আপডেট করা হবে)
আরও পড়ুন: শিক্ষিতের হার বাড়ছে কিন্তু মান বাড়ছে না কেন?