অজীর্ণ বা বদ হজম একটি কমন সমস্যা। শতকরা প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষ নিয়মিত এ ধরণের সমস্যায় ভুগে থাকে। অনেকে বিভিন্ন এলোপ্যাথি ওষুধ সেবন করতে করতে হাঁপিয়ে ওঠে।
তবুও তার বদ হজম বা অজীর্ণতা সারে না। আসলে প্রতিদিনই কিছু নিয়ম-কানুন এবং অভ্যাসের পরিবর্তন করার সাথে সাথে নির্দিষ্ট লক্ষণের সাথে মিল রেখে হোমিওপ্যাথি ওষুধ সেবন করলেই এ ধরণের সমস্যা সেরে যায়।
আজ আমরা মূলত আলোচনা করবো কিভাবে খুব সহজেই অল্প টাকার হোমিওপ্যাথি ওষুধ সেবনের মাধ্যমে অজীর্ণ বা বদ হজম সমস্যা থেকে মুক্তি পাবেন। আগেই বলে রাখি, নিজে নিজে ওষুধ সেবন করতে যাবেন না।
ওষুধ সেবনের পূর্বে অবশ্যই একজন অভিজ্ঞ হোমিওপ্যাথি চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। তা নাহলে বড় ধরণের ক্ষতি হতে পারে। তো আর কথা নয় – সরাসরি যাচ্ছি মূল আলোচনায়।
রোগের বিবরন: অনিয়মিত বা অতিরিক্ত ভোজন তৈলাক্ত চর্বিযু্ক্ত আহারাদি ভক্ষন, রাত্রি জাগরন, অতিরিক্ত চা কফি মদ্য পান, ধুমপান, শুরুপাক দ্রবাদি ভোজন ইত্যাদি কারন বশতঃ খাদ্য ভালরূপে পরিপাক না হইয়া অজীর্ণ রোগ জন্মায়।
ক্ষুধা লোপ কিংবা রাক্ষুসে ক্ষুধা গরম মসলাযুক্ত দ্রব্যাদি আহারের ইচ্ছা, বুক গলা জ্বালা, অম্ল উদগার, আহারান্তে পেট বেদনা, বুক ধড়ফড় করা ইত্যাদি লক্ষণও দেখা দেয়।
চিকিৎসা:
নাক্স ভমিকা (Nux Vomica): হিংসুটে স্বভাব ভীষন রাগী, কলহপ্রিয়, শীত কাতর, মদ্যপায়ী, নেশাখোর, অতিরিক্ত রাত্রী জাগরন, অধিক মসলাযুক্ত খাদ্য, গুরুপাক দ্রব্যাদি ভোজন বা অধিক ভোজন জনিত অজীর্ণ তথা খাদ্য দ্রব্য ভালরূপে পরিপাক না হইয়া আহারের দুই এক ঘন্টা পরে পেট ব্যথা, মুখে টক জল উঠে সহ ইত্যাদি লক্ষণে ইহা উপকারী।
সেবন বিধি: শক্তি 3x বা 6 তিন চার ফোঁটা সামান্য জলসহ দিনে তিন চার বার। পুরাতন রোগে 200 বা 1M দুই থেকে চার মাত্রা।
কার্বোভেজ (Corbo Veg): কোন প্রকার কঠিন অসুখে রোগী পাখার বাতাস চায়, মুক্ত হাওয়ার জন্য আকাঙ্খা, অন্ধকারে ভুতের ভয়, স্মৃতি শক্তি হ্রাস, শীত কাতর, এই ঋতুর রোগীদের কার্বোভেজ একটি মহৎ উপকারি ঔষুধ।
খাদ্য দ্রব্য ভালরূপ পরিপাক না হইয়া পেট ফাপে বিশেষ করে নীচের পেট দুর্গন্ধ বাত-কর্ম বা ঢেকুর উঠিলে আরামবোধ ইত্যাদি লক্ষণে 30 বা 200 শক্তি 3 ঘন্টা অন্তর কয়েক মাত্রা সেবন করিলে উক্ত রোগ আরোগ্য হয়। নাক্স প্রয়োগের পর অজীর্ণ পীড়া সম্পূর্ণ আরোগ্য না হইলে কার্বোভেজ 200 বা 1m 2 থেকে 3 মাত্রা প্রয়োগ করতে হবে।
লাইকোপোডিয়াম (Lycopodium): রোগী অতিশয় কৃপন, ভীরু, একা থাকিতে ভয়, মেজাজ রাগী, নতুন লোকের আগমনে ভয়, মনের আলন্দে ক্রন্দন, গরম খাবার পছন্দ, গরমে কাতর, অজীর্ণ পীড়ায় বেশ ক্ষুধা হয়।
সামান্য আহারে মনে হয় পেট ভরিয়া গিয়োছে। কোষ্ঠ বদ্ধ মাঝে মাঝে তরল মলের সঙ্গে কঠিন (শক্ত) মল দেখা যায়।
পেট ফাঁপে, টক ঢেকুর উঠে, ভুট-ভাট করে পেট ডাকে, বিকাল ৪ টা থেকে রাত ৮ টার মধ্যে রোগের বৃদ্ধি ইত্যাদি লক্ষনে 3 বা 6 শক্তি দিনে তিন মাত্রা 30 বা 200 শক্তি দিনে দুই মাত্রা পুরাতন রোগে 1m 10m বা আরো উচ্চ শক্তি প্রয়োগ করতে হবে।
নেট্রাম কার্ব (Natrum Carb): গোলমাল পছন্দ করে না, গান বাজনা নিতান্ত অপছন্দনীয়। শীত কাতর, দুধ খাইলে অজীর্ণ বা উদরাময়, সর্বদা পেট ভার বোধ, বায়ূ সঞ্চয় হইয়া পেট ফুলিয়া উঠে। কখনো কোষ্ঠবদ্ধ কখনো টক গন্ধযুক্ত তরল মল, শাক সবজি পানাহারে রোগ বৃদ্ধি ।
সেবন বিধি: শক্তি 6 বা 30 দিনে ৩ মাত্রা। পুরাতন রোগে 200 বা 1m সকাল বিকাল দুই মাত্রা ।
ইপিকাক (Ipecac): ঘূত পক্ক পোলাও, মাংস, অধিক মিষ্টি বা মিষ্টান্ন কিংবা গুরুপাক দ্রব্যাদি আহার করিয়া পেট বেদনা, পাতলা পায়খানা, বমি ও বমি বমি ভাব হইলে ইপিকাক উপকারী।
সেবন বিধি: শক্তি 3x সবসময় 3 বা 4 ফোঁটা সামান্য জলের সঙ্গে দুই ঘন্টা অন্তর।
পালসেটিলা (Pulsatilla): শান্ত স্বভাব কোমল মন অভিমানী অল্প কথায় মনে ব্যথা গরম কাতর মুক্ত বাতাস পছন্দ করে। এই ধাতু রোগীদের ইহা অধিক উপকারী।
চর্বি যুক্ত মাংস, ঘৃত পক্ক পোলাও অধিক মিষ্টি বা মিষ্টান্ন ভোজন জনিত অজীর্ন বা উদরামর পেট বেদনায় পালসেটিলা অমোঘ।
সেবন বিধি: শক্তি 3x চার ফোঁটা সামান্য ঠান্ডা জলের সাথে ২ ঘন্টা অন্তর।
ম্যাগনেসিয়া কার্ব (Magnesia Carb): খিটখিটে স্বভাব, বদ মেজাজী, শীত কাতর, মাংস খাবার অত্যন্ত পছন্দনীয়। এই ধাতুর রোগীতে ইহা অধিক কার্যকরী।
দুগ্ধ পান অসহ্য, পেট ফাঁপে, বুক জ্বলে, টক ঢেকুর উঠে, মুখে টক আস্বাদ, রুটি আলু বা দুধ খাইলে পেটে বায়ু জমে, শূল ব্যাথা হয় সহ প্রভৃতি লক্ষণে ইহা অনেক উপকারী।
সেবন বিধি: শক্তি 30 বা 200 দিনে 2 বার।
চায়না (China): সমস্ত পেট ফাঁপা, পাতলা পায়খানার সাথে অজীর্ণ খাদ্য নির্গত হয়। ফল খাইলে পেটের অসুখ বাড়ে অথবা ফল খাইয়া অজীর্ণ বা উদরাময় দেখা দেয়।
রোগী দিন দিন দুর্বল হইতে থাকে। খাদ্য দ্রব্য হজম না হইয়া আস্ত বা অর্ধ ভাঙ্গা নির্গত হয়। ইহাতে চায়না অব্যর্থ।
সেবন বিধি: শক্তি 3x বা 6 সচরাচর 3 থেকে ৪ ফোঁটা সামান্য জলের সহিত ৩ ঘন্টা অন্তর প্রয়োগ করতে হবে। তবে 30 বা 200 শক্তি অধিক উপকারী।
ক্যারিকা পেঁপেয়া (Carreca Papaya): যাহাদের হজম শক্তি দুর্বল, মাংস ডিম ও গুরুপাক দ্রব্যাদি এমন কি সামান্য দুধও হজম করিতে পারে না।
অল্প অল্প করিয়া দিনে রাত্রে কয়েকবার পায়খানায় যায়, অজীর্ণ তরল মল, চক্ষু হলদে, জিহ্বায় হলদে, ময়লা রক্ত, স্বল্প দুর্বল, পেট ফোলা এবং দুগ্ধ খাইলে অজীর্ণ বা উদরাময় দেখা দেয় ।
সেবন বিধি: শক্তি Q (মাদার) 8 থেকে 10 ফোঁটা সামান্য জলসহ আহারের পর শিশুদের অর্ধ মাত্রা। 3x শক্তি ব্যবহারেও অধিক উপকার পরিলক্ষণ করিয়াছি।
সালফার (Sulphur): খিট খিটে স্বভাব, অল্পতে উত্তেজিত হইয়া উঠে, অত্যন্ত স্বার্থপর, গরমে কাতর, অপরিস্কার অপরিচ্ছন্ন রোগী যাহারা প্রায়ই নানাবিধ চর্ম পীড়ায় ভোগে।
পায়ের তলায় জ্বালা, শরীরে দুর্গন্ধ ঘাম, রুটি আলু ও ঘৃত প্রভৃতি দ্রব্য আহার করিলেই পেট ফাঁপে, টক ঢেকুর উঠে। গন্ধকের বর্ণ পায়খানা, বাতকর্মে ভীষন দুর্গন্ধ – এই প্রকৃতির রোগীদের নতুন বা পুরাতন অজীর্ণ পীড়ায় ইহা অব্যর্থ।
সেবন বিধি: শক্তি 30 বা 200 দিনে 2 বার। পুরাতন রোগে 1m বা 10m সকালে 2 মাত্রা ।
বায়োক্যামিক চিকিৎসা:
নেট্রাম ফস (Natrum Phos): টক ঢেকুর উঠে, বুক জ্বলে, মুখে টক জল উঠে, হরিদ্রা বর্ণের জিহ্বা আহারের পর পেট বেদনা হয়।
অম্ল গন্ধযুক্ত বাহ্যে মাঝে মাঝে অম্ল বমন ইত্যাদি লক্ষনে ইহা উপকারী। লক্ষন অনুযায়ী হোমিওপ্যাথিক ঔষধের সঙ্গে বায়োক্যামিক ঔষধ পর্যায়ক্রমে সেবনে আরো অধিক উপকার হয়।
সেবন বিধি: শক্তি 6x বা 12x 1 থেকে 4 বড়ি একমাত্রা (বয়স অনুসারে) প্রত্যহ ৩ বার।
নেট্রাম মিউর (Natrum Mur): অত্যাধিক লবন প্রিয়, তিক্ত ঝাল খাইবার প্রবল ইচ্ছা, রুটি খাইতে অনিচ্ছা, রুটি খাইলে অজীর্ন পীড়া দেখা দেয়, মুখে জল উঠে, মাথা ধরে, অতিশয় জল পিপাসা সহ ইত্যাদি লক্ষণে ইহা অনেক কার্যকরী ঔষধ।
সেবন বিধি: শক্তি 6x বা 12x 2 থেকে 4 বড়ি একমাত্রা (বয়স অনুসারে) প্রত্যহ ৩ বার সেবন করতে হবে।
ক্যালকেরিয়া ফস (Calearea Phos): রক্ত হীন দুর্বল, জীর্ণ শীর্ণ রোগীদের হজম শক্তির দুর্বলতা, আহারে অনিচ্ছা, উদরে বায়ু জমে ইত্যাদি লক্ষনে বা অন্য ঔষধের সহিত পর্যায়ক্রমে ইহা সেবন অজীর্ণ পীড়া আরোগ্য হয়।
সেবন বিধি: শক্তি 3x বা 6x 2 থেকে 4 বড়ি একমাত্রা (বয়স অনুপাতে ) ৩ ঘন্টা অন্তর সেবন করতে হবে।
ক্যালি মিউর (Kali Mur): ঘৃত পক্ক বা অধিক তৈলাক্ত খাদ্য দ্রব্য আহার জনিত অজীর্ণ পীড়া, তৈলাক্ত উদগার উঠে এবং জিহ্বা সাদা বর্ণের প্রলেপ যুক্ত রোগীদের জন্য ইহা অধিক উপযোগী।
সেবন বিধি: শক্তি 6x 2 থেকে ৪ বড়ি একমাত্রা (বয়স অনুপাতে) ৩ ঘন্টা অন্তর সেবন করতে হবে।
পথ্য ও আনুষঙ্গিক ব্যবস্থা:
নিয়মিত আহার করা বিধেয়। ভাল ভাবে চর্বন করিয়া আহার করা উচিত। সকাল সন্ধ্যায় সাধ্যমত ব্যায়াম করা ভাল।
পুরাতন সরু চাউলের অন্ন, জীবিত শিং বা মাগুর মাছের ঝোল, কাঁচা কলা, কাঁচা পেঁপে সুপথ্য। গুরুপাক দ্রব্যাদি ভোজন নিষিদ্ধ।
বাস্তব রোগী বিবরন: আলেয়া নামে (৩২) এক মহিলা প্রায় নয় দশ মাস যাবৎ অজীর্ণ পীড়ায় ভোগে। এই বদরাগী মহিলা এলোপ্যাথিক ও কবিরাজী চিকিৎসা করে ব্যর্থ হয়ে অবশেষে আমার নিকট চিকিৎসার জন্য আসে।
পাঁচ-ছয় ঘন্টা পর পর পায়খানায় যায়। কিন্ত পায়খানা পরিস্কার হয় না। আহারের কিছু পর চিন-চিন পেট ব্যথা। দিন রাত্রে চার-পাঁচ বার পায়খানায় যায়।
মাঝে মাঝে নিস্ফল পায়খানা। দিন দিন শরীর দুর্বল হইতে থাকে। নাক্স 1m দুই মাত্রা বিকালে ও রাত্রে সেবন করিতে দেওয়ায় তিনি এক মাস ভাল থাকার পর পুনরায় উক্ত পীড়ায় আক্রান্ত হওয়াতে নাক্স 10m উক্ত নিয়মে সেবন করায় তিনি আরোগ্য লাভ করেন।
পরিশেষে বলা যায়, অজীর্ণ পীড়া সাধারণত বেশি হয় মানুষের বদ অভ্যাসের কারণে। তাই আসুন আমরা এই পীড়া সম্পর্কে সচেতন হই এবং নিয়মিত ব্যায়াম করি।
অভিজ্ঞ চিকিৎসকগণ যেভাবে দিক নির্দেশনা দেন সেভাবে জীবন-যাপন করি। আর এসব রোগে ভুড়ি ভুড়ি এলোপ্যাথিক ওষুধ সেবন না করে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা নেই। তবেই জীবনে মঙ্গল হবে। আমরা সুস্থ্ থাকবো এবং ভালো থাকবো।
আরও পড়ুন: গোল মরিচ এর অসাধারন সব উপকারিতা জেনে নিন।
2 Comments
আজগর আলী ভাই আপনার ফোন নাম্বার চাই
অলরেডি ফোন নাম্বার আপনি পেয়ে গিয়েছেন, ধন্যবাদ।